আমেরিকা , বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মিশিগানে কমছে ট্র্যাফিক টিকিট ও জরিমানা ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান মিশিগানে বরফ ভেঙে স্নোমোবাইল দুর্ঘটনা : দুই আরোহীর মরদেহ উদ্ধার ডেট্রয়েটে অগ্নিকাণ্ডে ৭ বছরের শিশুর মৃত্যু, মা আশঙ্কাজনক মহান বিজয় দিবস আজ আনিস আলমগীর ও শাওনসহ চারজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগ হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি–জামায়াত ও এনসিপি ডেট্রয়েট পার্কে শিশুর গলা কাটার চেষ্টা : প্রবীণ আসামির  ১৫ বছর কারাদণ্ড দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান গুলিবিদ্ধ  হাদিকে ঢাকা মেডিকেল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ ঢাকায় ডিএনসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিহত ফ্লেক্স-এন-গেট ডেট্রয়েটে বর্ণিল হলিডে পার্টি ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট : তফসিল ঘোষণা ভোটের ট্রেন ছাড়ছে সিলেটে মধ্যরাতে দুইবার ভূ-কম্পন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম সপ্তাহজুড়ে দক্ষিণ-পূর্ব মিশিগানে তুষারপাতের সম্ভাবনা

হবিগঞ্জ জেলার পিঠা- সংস্কৃতি : ঐতিহ্য ও বর্তমান

  • আপলোড সময় : ১৭-১২-২০২৫ ০২:০৯:১৩ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৭-১২-২০২৫ ০২:০৯:১৩ পূর্বাহ্ন
হবিগঞ্জ জেলার পিঠা- সংস্কৃতি : ঐতিহ্য ও বর্তমান
বহুমাত্রিক সৌন্দর্য আর মহিমায় বাংলাদেশ অনন্য এক অমরাবতী। এদেশের প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হৃদয়রঞ্জন সুন্দরতার অমৃত- হিল্লোল। কবি- কণ্ঠে শোনা যায় এর বিমুগ্ধ গুঞ্জরণ,-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর।”১
বৃহত্তর সিলেট এক্ষেত্রে ভাস্বর। সিলেটবাসীর পরম গৌরবের বিষয় হল, শুধুমাত্র সিলেটকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন। রূপমুগ্ধতা ব্যক্ত করেছেন শব্দের মূর্ছনায়,
“মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।
এ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সুশান্তকৃষ্ণ দাস। দিল্লী থেকে এ অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।”২

এই ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’র ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ হবিগঞ্জ। নিসর্গ-কন্যা হবিগঞ্জ এর একই অঙ্গে কত রূপ! এ জেলার বহু বরেণ্য সন্তান আন্তর্জাতিক আকাশে প্রদীপ্ত নক্ষত্র হয়ে আছেন। বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলন, বিশেষকরে মহান মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ হিরণ্ময় কিরণদ্যুতিতে ভাস্বর। “এ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ২য় ও ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে সমগ্র দেশকে ৪টি সেক্টরে বিভাজন করেন, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ কৌশলগত পরিচালনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে।”৩ 
এ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য স্বরূপ এখানে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন স্মৃতি স্তম্ভটি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। অন্যান্য ক্ষেত্রেরমত হবিগঞ্জের সংস্কৃতি বহুধা বিভক্ত ও বিচিত্রমাত্রিক।
এবার দেখা যাক সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায়। সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি দিনের নয়। “আচার্য সুনীতিকুমার মারাঠী ভাষায় Culture-এর প্রতিশব্দরূপে ‘সংস্কৃতি’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করেন, এবং বিষয়টির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি সেটি অনুমোদন করেন। সম্ভবত: তারপর থেকেই বাঙলা ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে।”৪
আচার্য সুনীতিকুমার Civilisation বা সভ্যতার সাথে Culture বা সংস্কৃতির সুদৃঢ় বন্ধন বিষয়ে বলেন, “Culture বা সংস্কৃতি বলিলে বুঝি তাহার উন্নত জীবনের অন্তরঙ্গ বস্তুগুলি- তাহার আধিমানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবন, তাহার সামাজিক জীবনের সৌন্দর্যময় প্রকাশ, তাহার সাহিত্য সৌন্দর্যবোধ, তাহার বাহ্যসভ্যতার আভ্যন্তর প্রাণবস্তু যাহা, মুখ্যত: তাহাই বুঝি। সভ্যতাতরুর পুষ্প যেন সংস্কৃতি।”৫  এককথায় সভ্যতা ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। নয়নের মাঝে নয়নের পাতার মতই অচ্ছেদ্য।

হবিগঞ্জের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি আপন ঐতিহ্যে দীপ্ত। এ অবিনাশীধারা বর্তমানে আরো বেগবান, বিস্তৃত, নান্দনিক। এর অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ হল পিঠা-সংস্কৃতি। সরঞ্জাম- সভ্যতা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে সাথে পিঠা তৈরির সরঞ্জামে নতুন নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হলেও কাঁঠের পিঁড়ি, বেলাইন, গাইল, ছিয়া, ঢেঁকি, বাঁশ, পাথরের যাঁতা, শিলপাটা, বাঁশের কুলা, ডালা ইত্যাদি আভিজাত্য ও কৌলিন্যে এখনো হবিগঞ্জের পিঠা-সংস্কৃতিতে সমাদৃত।
বস্তুত: মাটির মমতা রসেপুষ্ট আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে দীপ্র এ জেলার পিঠা-সংস্কৃতি। কৃষি- নির্ভর গ্রামবাংলার ঐতিহ্য তথা সাংস্কৃতিক প্রাণ- প্রবাহ এখানে শতধারায় উৎসারিত। এককথায় হবিগঞ্জ শিল্প- সংস্কৃতির চিরসবুজ দ্বীপপুঞ্জ।
ঈদ, পূজা, পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি উৎসবের পাশাপাশি দৈননিন্দ অতিথি আপ্যায়নে পিঠা এখানে ব্যাপকভাবে আদৃত। সর্বস্তরে বিশেষকরে বিবাহ অনুষ্ঠানে পিঠা অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিবাহকে কেন্দ্র করে নানারকম পিঠার সমাহার প্রাচীন ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে বর্তমানকালেও সজীব, প্রাণবন্ত। নতুন জামাইকে খাঞ্চা (বড় থালা) ভর্তি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বিয়ের পর মেয়ে প্রথম শ্বশুরবাড়ি
যাবারকালে অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে থাকে চিত্তরঞ্জী পিঠার সুরম্য বাহার। বিয়ের পরদিন কনের শ্বশুরবাড়িতে সকালের নাস্তা পাঠানো হয়, এখানেও পিঠা অপরিহার্য। সন্তান সম্ভবা কন্যাকে নতুন কাপড়-চোপড়সহ নানা উপকরণ সহযোগে ‘সাধ’ দেয়া নামক যে রীতি এ অঞ্চলে প্রচলিত সেখানেও পিঠার সীমাহীন মর্যাদা।
এ অঞ্চলে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য পাঠানোর রীতি প্রচলিত, এর মাঝে আম কাঁঠালের দিনে বিভিন্ন ফলের সাথে পিঠা- চিড়া পাঠানো অন্যতম। রমজান মাসে মেয়ের বাড়ি থেকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে ইফতারি পাঠানোর হরেক রকম উপাদানের মধ্যেও পিঠা থাকে।

উপকরণ- আতপ ও সিদ্ধ চালের গুঁড়া, খেজুর রস, পেঁয়াজকলি, লালিগুড়সহ বিভিন্নরকম গুড়, চিনি, সিমের বিচি, মাংস, নারিকেল, আদা, হলুদ, কাঁঠাল, দুধ, ক্ষীর, লবণ, মরিচ, ময়দা, শুটকি ইত্যাদি সহযোগে তৈরি পিঠা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। হবিগঞ্জে উৎপাদিত পশুশাইল নামক ধানের আতপ চাল পিঠার স্বাদে এনে দেয় ভিন্নরকম ব্যঞ্জনা। পিঠাভেদে গুঁড়া খুব মিহি, মাঝারি, মোটা হয়ে থাকে।
হবিগঞ্জের কিছু পিঠার নাম- হাপাইন্যা পিঠা, দুধচুরি পিঠা, ডুবা পিঠা, হান্দেস পিঠা (প্রচলিত নাম তেলের পিঠা), পোস্তদানা পিঠা, কুশলি পিঠা, গোকুল পিঠা, ঝিনুক পিঠা, বসবড়া, ফুলঝরা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধচিতই পিঠা, গোলাপফুল পিঠা, সিমের বিচি পিঠা, ভাপা পিঠা, তাল পিঠা, ডিম পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পুলি পিঠা, চন্দ্রপুলি পিঠা, মুই পিঠা, চুই পিঠা, চিকনাইর বড়া (চর্বিপিঠা), হিদলের পিঠা (ভর্তা পিঠা), ডাইলপিরা পিঠা, সম্সা পিঠা (সমুচা), কট্টা পিঠা, হাতকাটা পিঠা (নকশিপিঠা), রুটি পিঠা, চটা পিঠা, ছিটা পিঠা, পানি পিঠা (প্রভৃতি নামের রুটি), তারা পিঠা, দোল্লস পিঠা, হাউত্তা মালপোয়া পিঠা, ফুলনদলা পিঠা, আনারস পিঠা, লবঙ্গলতিকা পিঠা ইত্যাদি। পাঁপড় শ্রেণিতে আছে, চালুনকাটা, জালি, বিউটি, স্যালাইন, সাগুদানা ইত্যাদি। এসবের সাথে বুগনাই এর ঐতিহ্যও সুপ্রাচীনকালের।
প্রস্তুত প্রণালী- এবার আমরা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং বিচিত্রমাত্রিক কিছু পিঠার প্রস্তুতপ্রণালী বিষয়ে আলোকপাত করব।
হাপাইন্যা- বিন্নি চালের মিহি গুঁড়ায় সামান্য লবণ ও পানি ছিটা দিয়ে মেশাতে হবে। এবার মোটা চালুনে ঐ গুঁড়া চেলে তাওয়া গরম করে পরিমাণমত চামচে নিয়ে তাওয়াতে বিছিয়ে দিলে একটা রুটি হবে। এবার পূর্বে তৈরিকৃত পুর (এলাচিগুঁড়া, নারিকেল ও গুড়ের) রুটিতে দিয়ে পাটিসাপটার মত মুড়ে নিতে হবে।
চালুনকাটা- ভাজা চালের মিহি গুঁড়া, নারিকেল কুড়ানো বা বাটা ও চিনি পানি মিশিয়ে এমন মিশ্রণ তৈরি করা যাতে মোটা ছিদ্রের চালুনের উপর রেখে হাতের চাপ দিলে ছিদ্র গলিয়ে মিশ্রণ পড়ে। রোদে রাখা পাটির উপর ঐ মিশ্রণ চালুনিতে নিয়ে দ্রুত হেঁটে হেঁটে হাতের চাপ দিলে তা নিচে পড়বে। এভাবে সারা পাটিতে ছড়িয়ে শুকিয়ে তেলে ভেজা নেয়া।
স্যালাইন পাঁপড়- সিদ্ধ চালের গুঁড়া পানিতে ভিজিয়ে মিহি করে বেটে নেয়া। এতে পানি, লবণ ও রঙ মিশিয়ে ঘন থকথকে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। খালি স্যালাইনের বোতলে ভরে নিয়ে কলাপাতা বিছিয়ে আস্তে আস্তে বোতলের চাপ দিলে নলের মাধ্যমে মিশ্রণ বের হলে পছন্দমত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলাদা আলাদা পাঁপড় বানিয়ে ভালভাবে রোদে শুকিয়ে তেলে ভেজে উপরে চিনি ছিটিয়ে (চিনি ছাড়াও হয়)
পরিবেশন।
বুগনাই- এটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। সুপ্রাচীনকালের ঐতিহ্যের ধারক, বাহক এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। যে কোনো পুরানো ধান সারাদিন ভিজিয়ে রাখার পর পানি ঝরিয়ে পর পর তিনদিন পাটের বস্তা দিয়ে ঢেকে রোদে রাখা। তখন ধানে অঙ্কুর গজাবে। তিন চার দিন রোদে শুকিয়ে ঐ ধানের চাল করে ভিজায়ে গুঁড়া করা। এবার চুলায় পরিমাণমত পানি দিয়ে জ্বাল দেয়া। অবশ্যই কাঠের লাকড়ি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করতে হবে, এবং আঁচ থাকবে অল্প, মাঝে মাঝে নাড়া দিতে হবে, নইলে পুড়ে যাবে, সারাদিন জ্বাল চলবে। উল্লেখ্য যে, যত বেশি জ্বাল দেয়া হবে ততবেশি মিষ্টি, সুস্বাদু এবং যথার্থ হবে। এতে গুড়, চিনি বা কোনোরকম মিষ্টি জিনিস দেয়া হয় না। ঐ চালের গুঁড়াই মিষ্টি স্বাদ ধারণ করে। বিষয়টা সত্যিই চমকপ্রদ। পূর্ণ প্রক্রিয়ায় রান্না করলে বুগনাই গোলাপি রঙ ধারণ করে এবং মিষ্টির স্বাদও কড়া হয়। এর গন্ধেও একটা স্বকীয়তা আছে। সবমিলিয়ে বুগনাই আবহমান গ্রাম বাংলার সোনালি ঐতিহ্যের এক দৃষ্টিহারী দৃষ্টান্ত।
হবিগঞ্জের পিঠা-সংস্কৃতি ঐতিহ্যের আলোকোজ্জ্বল গরিমায় বৈচিত্র্যে, স্বাদে, চিত্রময়তায় অনন্য। এ জেলার মাটিতে জন্মে নানারকম শস্য। এ ধারায় তিলও উল্লেখযোগ্য। ব্যাপকঅর্থে ‘তিলের লেই’ হবিগঞ্জের পিঠার ডালায় অনায়াসেই ঠাঁই পেতে পারে। কালো তিলের খোসা ছাড়িয়ে প্রথমে টেলে নিয়ে গুঁড়া করতে হয়। এর সাথে সামান্য চালের গুঁড়া, লবণ মেখে পানিসহ জ্বাল দিয়ে থকথকে হলে নামিয়ে পরিবেশন করা।
তিলের লেই বেশ সুস্বাদু। চির সবুজ বাংলাদেশের সোঁদা মাটির গন্ধে ভরপুর এ ‘তিলের লেই’ আবহমান কালের শাশ্বত ঐতিহ্যের দ্যোতক এবং বিশিষ্টতাজ্ঞাপক।

হবিগঞ্জে বসবাস করছেন নানা সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। সমতল, পাহাড়, টিলা তথা বন-বনানীর স্নিগ্ধতায় তাঁরা বিচিত্রমাত্রিক জীবনচর্যার উদ্ভাসে সাংস্কৃতিক- বলয়ে যুক্ত করেছেন ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। অনন্য সুন্দরতা। এবার আমরা আরণ্য- সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত কিছু পিঠা বিষয়ে আলোকপাত করব।
নানাস পিঠা, নকশি পিঠা, মূগপাকন, খেজুর পিঠা, পুলি পিঠা, চন্দ্রপুলি পিঠা ইত্যাদি। (সাঁওতাল সম্প্রদায়)
চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা ইত্যাদি। (ভুনার্জি সম্প্রদায়)
পয়সা পিঠা, কাটা পিঠা, বেণী পিঠা, ক্লিপ পিঠা ইত্যাদি। (রবিদাস সম্প্রদায়)
অঙ্গুরি পিঠা, মাল্টা পিঠা, খাপরা পিঠা, লাড্ডু পিঠা ইত্যাদি। (উরাং, ওরাঁও, মুন্ডা,
তুরিয়া, খারিয়া, ঝরা সম্প্রদায়)
সিমরুটি পিঠা ইত্যাদি। (চা শ্রমিক সম্প্রদায়)
ডুরি পিঠা ইত্যাদি। (দেশওয়ালি বা কানু সম্প্রদায়)
উটংচাক পিঠা ইত্যাদি। (মনিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়)
প্রস্তুতপ্রণালী-
সিমরুটি পিঠা- সিমের তরকারি রান্না করে ঠাণ্ডা হলে চালের গুঁড়া মিশিয়ে মণ্ড তৈরি। তাওয়া বা কড়াই চুলায় বসিয়ে হালকা তেল মাখানো। চিতই পিঠারমত বানানো।
ডুরি পিঠা- মোটা দানার চালের গুঁড়া হালকা ভেজে বাদাম, চিনি, ভাজা ছোলার গুঁড়া, কিসমিস, সুগন্ধি চালের ভাজা গুঁড়া ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। পরিমাণমত গুঁড়ে পানি দিয়ে ঘন আঠালো শিরা করে এতে পূর্বের মিশ্রণ দিয়ে মণ্ড তৈরি করে নাড়ুর মত আকৃতি।
উটংচাক পিঠা- বিন্নি চাল পরিমাণমত পানিসহ মুলি বাঁশের চোঙায় ঢুকিয়ে দিয়ে চোঙার মুখ বন্ধ করতে হবে। এবার নিচ থেকে অল্প আগুন দিয়ে বাঁশের চোঙা ভালভাবে পুড়িয়ে নিতে হবে। বাঁশ পুড়ে গেলে আস্তে আস্তে তা তুলে তরকারি বা ভর্তার সাথে পরিবেশন।
খাপরা পিঠা- ঢেঁকিতে করা আতপ চালের গুঁড়ার সাথে পানি মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি। বেশি পাতলা বা ঘন যেন না হয়। (পাটিসাপটার গোলার মত) চুলাতে কড়াই গরম হলে কলার ডগার সাহায্যে তেল মাখিয়ে নিতে হবে। এখন ঐ পরিমাণ মিশ্রণ কড়াইতে দিতে হবে যাতে আকৃতিতে একটা পাতিলের মুখের সমান হয়। অর্থাৎ ঢাকনার সমান। এ পিঠা এঁটো করা যাবে না।

ওরাঁও, উরাং, সাঁওতাল, মুণ্ডা, খারিয়া, ঝরা সম্প্রদায়ে বিয়ের বর কনের গোসলের জন্য পানি সংগ্রহ করার সময় যে মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়- খাপরা পিঠা এ হাঁড়ির ঢাকনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পিঠা হাঁড়ির মুখে রেখে এমনভাবে নতুন মার্কিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় যাতে নির্ধারিত নারী পুরুষ ছাড়া অন্য কারো দৃষ্টিগোচর না হয়। এ কাজের জন্য দু’জন পবিত্র যুবতী নতুন বস্ত্র পরিধান করে। এদের সাথে
যে দু’জন পুরুষ থাকে, এরা হল বর ও কনের ছোট ভাই। এরাও নতুন কাপড় পরে আর সাথে রাখে দু’টো ধারালো দা। আদিবাসী রীতি অনুসারে তখন চিত্তরঞ্জী গান, নাচ, বাজনা অনুষ্ঠানে প্রাণসঞ্চার করে। পানি আনার পর এ পিঠা প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়।
লাড্ডু পিঠা- ঢেঁকিতে করা আতপ চালের গুঁড়া, পানি ও গোটা মরিচ এর উপকরণ। পবিত্র তরুণীর দল নতুন ডালায় আতপ চাল নিয়ে গান গেয়ে ঢেঁকিতে গুঁড়া করে। এ গুঁড়া
হাতের আঙুল ও মুঠোর সাহায্যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পিঠার আকৃতি দেয়। এবার পরিষ্কার হাঁড়িতে পরিমাণমত পানি দিতে হয়। পানির উপরে কিছু পোয়াল/খড় ছড়িয়ে দিয়ে আবারও খড় ছড়িয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ দু’বার খড় বিছিয়ে দেবার পর এর উপর উপকরণ ঢেলে ঢাকনা দিয়ে সেদ্ধ করার মাধ্যমেই পিঠা বানানোর কাজ শেষ হয়।
বিয়ের আগের দিন বর- কনে উভয়পক্ষই মাড়োয়া পূজা করে। যখন কালসা গাঁথা হয়, তখন এ পিঠা নতুন ডালায় সাজিয়ে পূজা স্থলে আনা হয়। একটা নতুন মাটির কলসিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধানের শিষ লাগানোকে কালসা বলে। কালসার মাধ্যমে মাড়োয়া পূজা শুরু হয়। তখন আদিবাসী বাজনা ও সানাই বাজানো হয়, কিন্তু কোনো গান হয় না। অন্যদিকে কালসা গাঁথার সময় বাজনারসাথে গানও থাকে। পূজা শেষে লাড্ডু প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। সাথে থাকে হাঁড়িয়া। 
এ সমস্ত পিঠার মাধ্যমে হবিগঞ্জের পিঠা- সংস্কৃতি আপন মাধুর্যে উদ্ভাসিত হওয়ার সাথেসাথে ঐতিহ্যের বর্ণোজ্জ্বল চলমানতার সাক্ষ্য বহন করে।
এসব পিঠার আলোচনায় যে সত্যটা দিবালোকের মত বিভাসিত তা হল, “সংস্কৃতির স্রোত প্রবাহিত হয় বিভিন্ন খাতে এবং এর বিকাশ ঘটে একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘকালের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, নৈতিক, রাজনৈতিক, নান্দনিক প্রভৃতি বিচিত্র কর্মকাণ্ডে।”৬ এই নান্দনিক ভুবনে পিঠা আপন বিভায় দীপ্ত।
উপযোগিতা- পিঠার উপযোগিতা ব্যাপক, বিস্তৃত এবং অবশ্যই কল্যাণকামী। এর মাধ্যমে মনন উৎকর্ষ সাধিত হয়। প্রতিফলিত হয় মানুষের সহজাত শিল্পবোধ, বর্ণজ্ঞান, হৃদয়ানুভূতি, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি। এর মাধ্যমে মনোভূমিতে অন্ত:সলিলা ফল্গুধারার মত শোভন ও সুন্দরতা শতধারায় উৎসারিত হয়। পিঠা- শিল্পীর সহজাত অনুধ্যান রূপে, রঙে, বর্ণে, ছন্দে, স্বাদে হিল্লোলিয়া ওঠে।
বর্তমানে অপসংস্কৃতির বিষবাষ্পে সমাজ-মানস বিক্ষত-জর্জরিত। সংস্কৃতির সুস্থ চর্চার মাধ্যমে আবহমান বাংলার প্রাণধারা বহমান। এই প্রাণধারাকে সতেজ, সজীব, বেগবান, সৃষ্টিশীল অর্থাৎ শেকড়মুখী মন-মনন
তৎপরতা ইত্যাদি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতির বর্ণিল বৈভব পিঠা আপন স্বাতন্ত্র্যে, মহিমায় বিশিষ্টতাজ্ঞাপক। দক্ষতাবৃদ্ধি, সার্বিক উন্নয়ন, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, সম্প্রীতিরক্ষা তথা কল্যাণমুখি মানসগঠনে পিঠার ভূমিকা অপরিমেয়।
শেকড় থেকেই শিখরে। শেকড়ের লালন, ধারণ, পরিবর্ধন, উন্নয়নে তৎপর থাকা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। কারণ, আবহমানকালের হাজার বছরের সাহিত্য, লোকসাহিত্য, বর্তমান সাহিত্য এমনকি রূপকথায়ও নানাবিধ পিঠার সমাহার ঐতিহ্যের কলগুঞ্জনে মুখরিত।
পিঠার প্রদীপ্ত পথ ধরে আমরা আপন সংস্কৃতিকে ভালবেসে দেশপ্রেমে আরো উজ্জীবিত হব। কারণ, পিঠা এক উন্নত মানের শিল্পকর্ম। আর সত্য, সুন্দর ও কল্যাণই হল শিল্পের প্রাণ-ভোমরা।
আমাদের আন্তর-জগতে পিঠার সৌন্দর্য বিকিরিত হোক। দেশপ্রেমের মায়াবি অরুণিমা আমাদের ঋদ্ধ করুক। চিন্তা-চেতনা মধুরিমা তরঙ্গ-বিভঙ্গে হোক কল্যাণকামী।
এককথায় পিঠা-সংস্কৃতির অমিয়াধারা সিঞ্চনে আমাদের মন- মনন সমুদ্ভাসিত হোক ঐতিহ্য- গৌরবের সমুন্নত মহিমায়।
তথ্যসূত্র:
১। রূপসী বাংলা, জীবনানন্দ দাশ, বুকস ফেয়ার, ঢাকা, ২০২২, পৃ. ২৫
২। শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯,
পৃ. ২২
৩। পাহাড় টিলা হাওড় বন: হবিগঞ্জের পর্যটন, জেলা প্রশাসন, হবিগঞ্জ, ২০১৮,
পৃ. ৮৬
৪। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়, শ্রী পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, জয়দুর্গা
লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ৫৮-৫৯
৫। পূর্বোক্ত
৬। জগৎ জীবন দর্শন, ড. আমিনুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ. ৪০
৭। ব্যক্তি- পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, হ্যাপি ভৌমিক, রেনু বেগম, হরেন্দ্র ওরাং,
গৌতমচন্দ্র দাশ, কামাল আহমেদ, মামুন আহমেদ, মহারাজ সাঁওতাল, সুচিত্রা
ভুনার্জি, দিপালি রবি দাস, কাজরি ওরাং।


 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য

সর্বশেষ সংবাদ
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে প্রয়াত ব্রজেন্দ্র দেবনাথের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত

ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে প্রয়াত ব্রজেন্দ্র দেবনাথের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত